Type Here to Get Search Results !

যৌতুককে না বলুন পর্ব–০২! যৌতুক হারাম-অনেক হারামের সমষ্টি!

যৌতুকের লেনদেন এত জঘণ্য অপরাধ যে, তা শুধু হারাম বা কবীরা গুনাহ নয়, এমন অনেকগুলো হারাম ও কবীরা গুনাহর সমষ্টি, যার কোনো একটিই যৌতুকের জঘণ্যতা ও অবৈধতার জন্য যথেষ্ট ছিল।
১) মুশরিক-সমাজের রেওয়াজঃ
যৌতুকের সবচেয়ে নগণ্য দিক হল, তা একটি হিন্দুয়ানি রসম বা পৌত্তলিক সমাজের প্রথা। আর কোনো মুসলিম কোনো অবস্থাতেই কাফের ও মুশরিকদের রীতি-নীতি অনুসরণ করতে পারে না।

২) জুলুম ও নির্যাতনঃ
যৌতুক শুধু জুলুম নয়, অনেক বড় জুলুম। আর তা শুধু ব্যক্তির উপর নয়, গোটা পরিবার ও বংশের উপর জুলুম। যৌতুকের কারণে কনে ও তার অভিভাবকদের যে মানসিক পীড়ন ও যন্ত্রণার শিকার হতে হয় তা তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অথচ কাউকে সামান্যতম কষ্ট দেওয়া ও জুলুম করাও হারাম ও কবীরা গুনাহ।

জালিমের উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ এবং জালিমের ঠিকানা জাহান্নাম। মজলুমের ফরিয়াদ সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায় এবং যেকোনো মুহূর্তে আল্লাহ জালিমের উপর আযাব ও গযব নাযিল করতে পারেন।

৩) পরস্ব হরণঃ
কুরআন মজীদে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

لا تأكلوا اموالكم بينكم بالباطل

তোমরা বাতিল উপায়ে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না।
-সূরা বাকারাঃ ১৮৮; সূরা নিসাঃ ২৯

বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-

إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم عليكم حرام كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا.

নিঃসন্দেহে তোমাদের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের জন্য এমনভাবে সংরক্ষিত, যেমন হজ্বের দিবসটি হজ্বের মাস ও (হজ্বের শহর) মক্কায় সংরক্ষিত।

সুতরাং কারো জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুতে হস্তক্ষেপ করা  হজ্বের সম্মানিত মাসে, হজ্বের সম্মানিত দিবসে হারাম শরীফের উপর হামলার মতো অপরাধ।
-সহীহ বুখারী, হাদীসঃ ১৭৩৯;
-সহীহ মুসলিম, হাদীসঃ ১৬৭৯)

নিঃসন্দেহে যৌতুক নেওয়া ‘আকল বিলবাতিল’ বা পরস্ব হরণের অন্তর্ভুক্ত। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। এটি ব্যবসা বা অর্থোপার্জনের উপায় নয়। তেমনি বর-কনেও ব্যবসার পণ্য নয়, যাদেরকে বিক্রি করে পয়সা কামানো হবে। যারা বিয়ের মতো পবিত্র কাজকে ‘সোর্স অফ ইনকাম’ বানায় তারা আল্লাহর বিধানের অবজ্ঞাকারী। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা যে ‘আকল বিল বাতিল’ কে হারাম করেছেন তার অর্থই হল, এমন কোনো পন্থায় সম্পদ উপার্জন, যাকে আল্লাহ উপার্জনের মাধ্যম বানাননি। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি হজ্বের মহিমান্বিত মাসের মহিমান্বিত দিবসে খানায়ে কাবার উপর হামলা করার মতো অপরাধ।
৪) ডাকাতি ও লুটতরাজঃ
কে না জানে, অন্যের সম্পদ লুট করা কবীরা গুনাহ! বড় কোনো সম্পদ নয়, যদি জোর করে কেউ কারো একটি ছড়িও নিয়ে যায় সেটাও গছব ও লুণ্ঠন, যা সম্পূর্ণ হারাম। লুণ্ঠিত বস্ত্ত অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়া ফরয। হাদীস শরীফে ইয়াযীদ ইবনুস সায়েব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

لا يأخذن أحدكم متاع صاحبه لعبا جادا وإذا أخذ أحدكم عصا أخيه فليرددها عليه

অর্থাৎ কেউ যেন তার ভাইয়ের জিনিস উঠিয়ে না নেয়; না ইচ্ছা করে, না ঠাট্টাচ্ছলে। একটি ছড়িও যদি কেউ তুলে নেয় তা যেন অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
-মুসনাদে আহমদ, হাদীসঃ ১৭৯৪০; ১৭৯৪১; ১৭৯৪২;
-সুনানে আবু দাউদ, হাদীসঃ ৫০০৩;
-জামে তিরমিযী, হাদীসঃ ২১৬০

যৌতুক নেওয়া কারো সামান্য জিনিস তুলে নেওয়ার মতো বিষয় নয়; বরং তা সরাসরি লুণ্ঠন ও ডাকাতি। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ছুরি-চাকুর বদলে বাক্যবান ও চাপের অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়, যা মজলুমের মন-মানসে অনেক বড় ও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তো ডাকাতি ও লুটতরাজের যে গুনাহ যৌতুক নেওয়ার গুনাহও তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

৫) রিশওয়াত ও ঘুষঃ
আত্মসাৎ ও অবৈধ উপার্জনের যতগুলো পন্থা আছে তন্মধ্যে নিকৃষ্টতম ও জঘণ্যতম একটি পন্থা হল রিশওয়াত। এর বাংলা তরজমা করা হয় ‘ঘুষ’ বা ‘উৎকোচ’।

অনেকে মনে করেন, অফিস-আদালতে নিজের বা অন্যের কোনো বৈধ পাওনা উসূল করার জন্য বা সঠিক রায় পাওয়ার জন্য কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাপ, অশোভন আচরণের শিকার হয়ে যে অর্থ দেওয়া হয় কিংবা অবৈধ সুবিধা হাসিলের জন্য যা খরচ করা হয় তা হচ্ছে ঘুষ। অবশ্যই তা ঘুষ। তবে ঘুষ ও রিশওয়াত শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে রিশওয়াতের অর্থ আরো ব্যাপক।  কারো কোনো হক বা পাওনা, যা কোনো বিনিময় ছাড়াই তার পাওয়া উচিত, তা যদি বিনিময় ছাড়া না দেওয়া হয় তাহলে ঐ বিনিময়টাই হল ঘুষ বা রিশওয়াত, যা হতে পারে অর্থ, সেবা বা অন্য কোনো সম্পদ। এটা দেওয়া হারাম, নেওয়া হারাম এবং এই লেনদেনে মধ্যস্থতা করাও হারাম। এটা এত বড় অপরাধ যে, এর সাথে যুক্ত সবার উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ। (আননিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ওয়াল আছার, ইবনুল আছীর (৬০৬ হি.) ২/২২৬; আলফাইক ফী গরীবিল হাদীস, যমখশরী (৫৩৮ হি.)

হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لعنة الله على الراشي والمرتشي

অর্থাৎ ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ।
-মুসনাদে আহমদ, হাদীসঃ ৬৭৭৮, ৬৯৮৪;
-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীসঃ ৫০৭৭;
-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীসঃ ২৩১৩

অন্য হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন-

لعن الله الراشي والمرتشي والرائش الذي يمشي بينهما

ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা ও ঘুষের লেনদেনে মধ্যস্থতাকারী সকলের উপর আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। আলমুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, হাকীম আবু আবদিল্লাহ ৪/১০৩

বিয়ের পয়গাম দিতে পারা নারী-পুরুষের বৈধ অধিকার। পয়গাম কবুল হলে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারাও নারী-পুরুষের বৈধ অধিকার।  বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীকে পাওয়া এবং স্ত্রী তার স্বামীকে পাওয়া তাদের প্রত্যেকের ফরয হক ও অপরিহার্য অধিকার। এরপর যতদিন বিবাহ-বন্ধন অটুট থাকে, একে অন্যের নিকট থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করাও স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য অধিকার। তো এই অধিকারগুলোর কোনো একটি পাওয়ার জন্য বা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কোনোরূপ অর্থব্যয়ের বাধ্যবাধকতা সম্পূর্ণ অবান্তর। সুতরাং এক্ষেত্রে কোনো অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপের মাধ্যমে কোনো কিছু গ্রহণ করা হলে তা হবে সরাসরি ঘুষ ও রিশওয়াত, যার লেনদেন সম্পূর্ণ হারাম এবং লেনদেনকারী ও মধ্যস্থতাকারী সবাই আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপের উপযুক্ত।

৬) লালসা হিংস্রতা ও চারিত্রিক হীনতাঃ
এই সব পাশবিক প্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এইসব ঘৃণ্য প্রবণতা প্রকাশিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যজনক। যে সমাজের লোকেরা এই সব দোষ ও দুর্বলতার  সংশোধন করে না; বরং কর্ম ও আচরণে পশুত্বের পরিচয় দিতে থাকে তাকে তো মনুষ্যসমাজ বলা যায় না। একজন ইনসান, উপরন্তু সে যদি হয় মুমিন, তাহলে অন্যের ধন-সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রুর উপর কীভাবে হস্তক্ষেপ করে? কারো দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ সে কীভাবে নেয়? এ তো কমিনা ও কমবখত লোকের কাজ। যার মাঝে বিন্দুমাত্র শরাফতও আছে তারও তো এই অপকর্মের হীনতা উপলব্ধি করা কঠিন নয়।

যৌতুক, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন এবং যত ধরনের দুর্নীতি এই সমাজে প্রচলিত তা সবই ঐ পাশবিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এখন প্রত্যেকের  কর্তব্য, নিজেকে ও নিজের অধীনস্ত সকলকে পশুত্বের হীনতা থেকে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় উন্নিত করার চেষ্টা করা। এটা এখন সময় ও সমাজের অপরিহার্য-দাবি। আর এর একমাত্র উপায় হচ্ছে, আখিরাতের স্মরণ ও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতিকে শক্তিশালী করা। এজন্য দ্বীনী শিক্ষার বিস্তার, আখলাক-চরিত্রের সংশোধন এবং নেককার বুযুর্গানে দ্বীনের জীবন ও আদর্শ চর্চার কোনো বিকল্প নেই।

৭) এক অপরাধ অসংখ্য অপরাধঃ
শরীয়তের একটি সাধারণ নীতি এবং একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, কোনো কাজের দ্বারা যদি হারামের দরজা খোলে তাহলে সেটাও হারাম হয়ে যায়। তাহলে যে কাজ নিজেও হারাম এবং আরো অনেক হারামের জনক তা কত জঘণ্য ও ভয়াবহ হতে পারে? তো যৌতুক এমনই এক অপরাধ, যা আরো বহু অপরাধের জন্ম দিয়ে থাকে।

যৌতুকের দাবি পূরণের জন্য অনেক অভিভাবক সুদ-ঘুষের কারবার ও বিভিন্ন হারাম উপার্জনে লিপ্ত হয়। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।

আর স্ত্রীর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন এমনকি হত্যা ও আত্মহত্যাও সাধারণ বিষয়।

তেমনি কনেপক্ষ শক্তিশালী হলে দুই পরিবারে বিবাদ-বিসংবাদ, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি খুন-জখম পর্যন্ত হতে থাকে। দৈনিক পত্রিকার পাঠক এসব ঘটনায় রীতিমতো অভ্যস্ত!

যৌতুকের সবচেয়ে ন্যূনতম ক্ষতিটি হল এর কারণে দাম্পত্য সম্পর্কের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। পরিবারে   অশান্তির আগুন জ্বলতে থাকে। ঝগড়া-বিবাদ গালিগালাজ এমনকি মারধর পর্যন্ত হয়। যার প্রত্যেকটিই এক একটি কবীরা গুনাহ এবং পরিবার ও সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে টেনে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সন্তানমাত্রই আল্লাহর রহমত, তবে কন্যা আল্লাহর বিশেষ রহমত কিন্তু যৌতুকের কারণে অনেক পিতামাতা কন্যার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, যা চরম মূর্খতা ও জাহিলিয়াত।

আরো বেদনার বিষয় এই যে, ছেলের মা বোনেরাও নববধুর কাছে যৌতুক দাবি করতে পিছপা হয় না। নারী হয়েও তারা নারীর যন্ত্রণা বোঝে না, তার প্রতি সহমর্মী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তো জা-ননদ-শাশুড়িই হয়ে ওঠে নব বধুর সবচেয়ে বড় দুশমন।

তো যারা যৌতুক দাবি করে বা গ্রহণ করে তাদের উচিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী স্মরণ রাখা-

لا يدخل الجنة لحم نبت من سحت النار أولى به

ঐ দেহ বেহেশতে যাবে না, যা হারাম (গিযা) থেকে উৎপন্ন হয়েছে। দোযখের আগুনই তার অধিক উপযোগী।
-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীসঃ ১৭২৩, ৪৫১৪;
-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীসঃ ২০৭১৯

তদ্রূপ যারা এই কু-রসমের প্রতিরোধ করে না; বরং নিজেদেরকে অক্ষম মনে করে কিংবা যৌতুক দিয়ে জামাতার মনোতুষ্টি কামনা করে তাদের মনে রাখা উচিত, কারো পাপ-দাবি পূরণ করাও পাপ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা তাদের দ্বিতীয়বার স্মরণ করা উচিত-ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ।

এই অভিশপ্ত ব্যধি থেকে আল্লাহ আমাদের সমাজকে পবিত্র করুন, সকল কুফরী ও শিরকী কর্মকান্ড থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন এবং একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এই সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন।

বিঃদ্রঃ আমাদের পোষ্ট গুলো যদি আপনার ভাল লাগে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। তাহলে আরও ভাল পোষ্ট নিয়ে হাজির হব।
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.